শনিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

আল মাহমুদের নোলক-এ বাংলাদেশ

  

আল মাহমুদের মা আর কারো মা না হলেও, এই নদীমাতৃক সবুজশ্যামল দেশে বেড়ে ওঠা সন্তানদের মতো অবশ্যই। যে মাকে সারা বাংলাদেশে খুঁজতে গিয়ে কবি দেখেছেন এবং দেখিয়েছেন নদীভরা বোয়াল মাছ, সাদা পালক ছড়ানো বকের দল। সবুজ বনে হরিৎ টিয়ের ঝিকমিক।
নোলক আবহমান বাঙালী মায়েদের নাকের অলংকার হলেও এ শুধু তার অর্থগত আর সৌন্দর্যের কারণেই গুরুত্বপূর্ণ না, গুরুত্বপুর্ণ আরো বড় কারণে। কবি এখানে আক্ষরিক অর্থের নোলক খোঁজেনি, খুঁজেছেন এর ঐতিহ্য এবং ঐশ্বর্যকে।
সংস্কৃতি বলতে আমরা যা বুঝি তার মধ্যে নিজস্ব সংস্কৃতি বলে একটি কথা আছে। সেই সংস্কৃতির মূল্যবোধকে ভক্তিভরে দীর্ঘ চর্চায় মানুষ এক ধরনের বিশেষ অবস্থানে পৌঁছে যায়। নোলক গ্রাম বাংলার সাধারণ নারীর নাকের অলংকার, এটা যতটা না অলংকার তার চেয়েও বেশি অহংকার। পাত্র বা পাত্রপক্ষের পছন্দ হলে পাত্রীকে পাত্র অথবা পাত্রপক্ষ বিয়ের নিশ্চয়তা স্বরূপ এই নোলক দিয়ে থাকেন। তার নারীত্বের এক ধরনের স্বীকৃতি। নোলক নারী আগলে রাখে যতোটা না অলংকার হিসেবে তার চেয়ে বেশি পুরুষের উপযুক্ত হওয়ার গৌরব এবং পুরুষের অনুভব হিসেবে। দেখা যায় কঠিন অভাবে পড়ে সবকিছু বিকিয়ে দিলেও গ্রামবাংলার সে নারী তার নাকের নোলকটি আগলে রাখার চেষ্টা করে।
সেই নারী মা হলেন। হারালেন তার মহা মূল্যবান নোলক। তখন সন্তান দায়িত্ব নিলো তার মায়ের হারিয়ে যাওয়া নোলক খুঁজে বার করবার।

সন্তান তার মায়ের হারিয়ে যাওয়া নোলক খুঁজতে গিয়ে দেখতে পাচ্ছে তার প্রাকৃতিক প্রাচুর্য। পাতার ফাঁকে হাজার হরিণের বাঁকানো মুখ। প্রকৃতির সারল্য এবং সুগন্ধের মতো উপঢৌকনের প্রস্তাব। প্রকৃতি তার অকৃত্রিম সারল্যে বলে দেয়-‘আমরা তো সব পাখপাখালি বনের সাধারণ।
সবুজ চুলে ফুল পিন্দেছি নোলক পরি নাতো !
ফুলের গন্ধ চাও যদি নাও, হাত পাতো হাত পাতো’
অন্যদিকে পাহাড়ও দেখায় তার আহার ভরা বুক।
নোলক কেউ ছিনিয়ে নিলে ফিরে পাবার যুদ্ধ করার একটি সুযোগ থাকে। আমরা সেই যুদ্ধ করেছি। বিজয়ও পেয়েছি।

বাস্তবতা বলছে নোলক এখন আর সেভাবে হারায়নি যেভাবে হারালে প্রতিপক্ষের সাথে যুদ্ধ করে ফেরত আনা যায়। নোলক হারিয়েছে আমাদেরই মাঝে, যেটা আরো ভয়ংকর।
………………………………………………………..

নোলক // আল মাহমুদ

আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে

হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে ?
-হাত দিওনা আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।
বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বাঁকে
শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছড়িয়ে থাকে।
জল ছাড়িয়ে দল হারিয়ে গেলাম বনের দিক
সবুজ বনের হরিণ টিয়ে করে রে ঝিকমিক।
বনের কাছে এই মিনতি, ফিরিয়ে দেবে ভাই,
আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরকে যেতে চাই।
কোথায় পাবো তোমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া ধন
আমরা তো সব পাখপাখালি বনের সাধারণ।
সবুজ চুলে ফুল পিন্দেছি নোলক পরি নাতো !
ফুলের গন্ধ চাও যদি নাও, হাত পাতো হাত পাতো
বলে পাহাড় দেখায় তাহার আহার ভরা বুক
হাজার হরিণ পাতার ফাঁকে বাঁকিয়ে রাখে মুখ।
এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন, ফের বাড়ালাম পা
আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।
………………………………………………………..
আমরা আমাদের সংস্কৃতি থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যাচ্ছি, দূরে আমরা ইচ্ছে করে যাচ্ছি না-সরাচ্ছে পরিস্থিতি। সেই পরিস্থিতির দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র পারছে না আমাদের সংস্কৃতি রক্ষা করতে। পারছে না প্রাত্যহিক জীবনে এর প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিত করতে। বরং তার অগণতান্ত্রিক মানসিকতার প্রকাশ আমরা পাই যখন দেখি দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে রায় দেয় মোবাইলে রিংটোন কি হবে সে বিষয়ে। তারা কেন জানবে না যে জোর করে বা আইন করে সংস্কৃতির চর্চা হয় না! ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ব্যক্তির কোন ভাষার গান ভালো লাগবে সেটা বোঝাই যায়। রুটি-রোজগারের প্রয়োজন মেটাতে বাংলার চাইতে ইংরেজিই ব্যক্তিকে বেশি সমর্থন দেয়, আমি ইংরেজি-নির্ভর হবো না কেন? পুরো পদ্ধতিটাই হয়ে পড়েছে গোলমেলে। আমি গরুকে ঘাস খাওয়াতে পারব না, খাওয়াতে পারব পানি; কিন্তু গরুর কাছে চাইব দুধ! তা কী করে হয়। সমস্যার মূলে না গেলে সমস্যার সমাধান করতে যে যাবে আল্টিমেটলি সমস্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সে-ই অবদান রেখে আসবে । এতে সংস্কৃতির অবস্থা এবং রাষ্ট্রের সর্বশেষ শক্তি প্রয়োগও দেখা যায়। এগুলো সবই আমাদের সংস্কৃতির করুণ পরিস্থিতিরই ইঙ্গিত দেয়।
নোলক খুঁজতে গিয়ে আল মাহমুদ যে বোয়াল মাছে ভরা নদী দেখিয়েছে, তা আর থাকছে? ৫৪টি অভিন্ন নদী প্রবাহ শুকিয়ে আসছে। আমরা সেটি নিয়ে কতটুকু ভাবি। আল মাহমুদ বোয়াল মাছ দেখিয়েছে যে নদীতে- এখন সেই নদীগুলোই হারিয়ে যাওয়ার পথে।
নোলক খুঁজতে খুঁজতে যে প্রাকৃতিক সম্পদ কবি দেখিয়েছেন এখন তার সব কিছুই হুমকির মুখে। পরিবেশবিদরা বারবার বলছেন প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নদী শুকিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এই মহা গুরুত্বপুর্ণ বিষয়টি রাষ্ট্র কতটুকু আমলে নিচ্ছে?
বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে মানুষ। সামগ্রিকভাবে বাঁচার প্রয়ােজন হারাচ্ছে তার চেতনা থেকে। ক্ষুদ্র হতে চাওয়ার প্রবণতা মানুষকে এমন ক্ষুদ্রতায় আবদ্ধ করে ফেলেছে যে- সে তার এক ঘটি পানি বা ট্যাপ থেকে নিসৃত এক মগ পানিকেই সত্য মনে করছে। কারণ ক্ষুদ্রতায় অন্ধত্বের কারণে তিনি বুঝতে চাইছেন না যে তার এই পানি আসলে নদীই যোগান দিচ্ছে।
এই সমস্যা ব্যক্তি বুঝলেও দায়িত্ব নিবে না। কারণ সমস্যাটি সামগ্রিক, এ জন্য রাষ্ট্র আছে। রাষ্ট্র সবার অভিভাবক।
আল মাহমুদের ‘নোলক’ কবিতায় যে বাংলাদেশ আমরা দেখতে পাই তাকেই যেন হারিয়ে খোঁজার সময় এখন।
খুঁজতে হবে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যকে। খুঁজতে হবে সেই মূল্যবোধকে। এবং তা খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরে স্বস্তি হবে না। আল মাহমুদের ‘নোলক’ কবিতাটি পড়লে বারবার এই সত্যেরই উপলব্ধি হয়। বাস্তবতাও এই কবিতাটি বারবার মনে করিয়ে দেয়। তাছাড়া কবিও বলেছেন-‘এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন, ফের বাড়ালাম পা / আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।’ এ মা আসলে আমাদের দেশমাতৃকা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনাকে ধন্যবাদ ভেদরগঞ্জ কোচিং সেন্টার এন্ড ট্রেনিং ইন্সটিটিউট পরিবারের পক্ষ থেকে।