বুধবার, ৮ মে, ২০১৯

পরীক্ষার ফলাফল ও একটি আত্বহত্যা।

কয়েকদিন আগেই এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলো। কোন বোর্ডে কতজন পাস করলো সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশ ফেলের হিসাব নেওয়া হচ্ছে। পাসের হার ছেলে না মেয়েদের বেশি তাও নির্ণয় করা হয়েছে। সার্বিকভাবে পাসের হার একটু কমে এসেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে কোনো শিক্ষার্থীই পাস করতে পারেনি। ফেল করে সামাজিক অবস্থায় তাদের লজ্জাজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ফেল করে আত্মহত্যার খবরও আসছে। প্রায় বিশজন ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছে। কেউ চিরক’ট লিখে আত্মহত্যা করেছে। সেই চিরক’টে জিপিএ ফাইভ না পাওয়ার হতাশার কথা বলে গেছে। বিষ্ময়কর ব্যাপার! জিপিএ ফাইভ না পেলেই আত্মহত্যা করতে হবে? কিন্তু কেন? আত্মহত্যা কেন? একবার ফেল বা জিপিএ ফাইভ না পেলেই কি জীবনের সব শেষ হয়ে যায়? এতো তুচ্ছ এ জীবন!

যারা পাস করতে পারেনি তাদের প্রতি আমার তেমন মন খারাপ নেই। এটা ঠিক যে পরীক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যই ছিলো একটা ভালো ফলাফল করা। সেটা না হলে মন খারাপ হওয়ারই কথা। কিন্তু তার থেকেও আমার মনে আশংকা থাকে প্রায় প্রতিবারই এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার পর কারও কারও আত্মহননের খবর পত্রিকায় পড়তে হয়। এটা সত্যি অত্যন্ত দুঃখজনক। জীবনটা তো অনেক বড়। সমস্যাটা হলো ফল প্রকাশের পর অনেক অভিভাবকও কোমল আচরণ করেন না বলেই আমার মনে হয়। এমনকি তার প্রতিবেশি ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকেও তার জন্য বিরূপ আচরণ হয়ে থাকে।
 
এই ফল প্রকাশ হওয়ার পর আমি একজন অভিভাবককে চিনি যে জিপিএ ফাইভ পায়নি। সামান্য পয়েন্ট কম পেয়েছে। এতে দেখলাম তিনি যারপরনাই হতাশ। তার মতে ভবিষ্যতের একটা দিক নাকি তার মেয়ের নষ্ট হয়ে গেছে! এই হলো অবস্থা। প্রতিযোগীতা ভালো। তবে তা জীবনের বিনিময়ে অবশ্যই নয়। ফল খারাপ হয়েছে তবে ভালো করার সুযোগও তো আছে। কোথাও কোথাও লেখা হয়েছে ফল বিপর্যয়। আবার কোথাও কোথাও মেধার সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে বলে বলা হচ্ছে। আসলে গত কয়েক বছরে পাসের হার বৃদ্ধি এবং গত দুইবছর পাসের হার কমের কারণে এমনটা মনে হচ্ছে। আসলে মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তন করা হয়েছে বলে গতবারই জানতে পেরেছি। সবাই চাইছিলাম পাসের হারে বৃদ্ধি না বরং মেধার হারে বৃদ্ধি ঘটুক। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীসহ সকলেই সেটাই চান। মেধাবী শিক্ষার্থী যাচাইয়ে যদি পাসের হার কমে তাহলে একটুও আফসোস নেই। কারণ কয়েকজন নামমাত্র শিক্ষিত বেকার যুবকের চেয়ে একজন প্রকৃত মেধাবী দরকার। কারণ সেই একজন বাকিদের কাজের ক্ষেত্র তৈরিতে ভূমিকা রাখে। তাই পাসের হারের কারণে মেধার সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে বলেই মনে হয়। 

সৃজনশীল পদ্ধতির জটিলতার কারণে বছর দুয়েক আগেও গণিতের ফলাফলে খারাপ হওয়ার কারণে সার্বিক ফল একটু খারাপ হওয়ায় হইচই পরে গিয়েছিল। বিষয়টা এমন যেন সবাইকে পাস করতে হবে। ফেল করা যেন মহা অপরাধ। আর তাই তো ফল প্রকাশের পরপরই দেশে কয়েকটি আত্মহননের খবর চোখে পরেছে। এটা একেবোরে অনাকাঙ্খিত। সফলতা এবং ব্যর্থতা- জীবনের এই দুটি দিক গ্রহণের মানসিকতা থাকা উচিত। কেউ বলছে এ বছর মেধার সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সঠিক মূল্যায়ন বলতে সেই পরিমাপ কতটা সঠিক তা বলা যায় না। কারণ আজকাল বিভিন্ন পদ্ধতি বারবার পরিবর্তন করা হয়। এ প্লাস প্রাপ্তদের সংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল তা বেশিরভাগের চোখেই ছিল সন্দেহের দৃষ্টিতে। তাই এ পরিবর্তনটা জরুরি ছিল। এ প্লাস শিক্ষার্থীদের সেই আই অ্যাম জিপিএ ফাইভ মার্কা আলোচনা সমালোচনা আজও মনে আছে। সত্যি কথা বলতে এইসব শিক্ষার্থীকে আমি কমই দোষারোপ করি। ভিত্তি যদি দুর্বল হয় তাহলে ওপরের অংশ নরবড়ে হবেই। একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস সঠিক কতজন শিক্ষার্থী বলতে পারবে? যদিও প্রাথমিক থেকেই তাদের জানার কথা। কিন্তু আদৌ সবাই জানে কি? আমাদের জাতীয় দিবসগুলো সম্পর্কে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সব শিক্ষার্থী জানে কি? বইয়ের বাইরে এরা আসলে বেশি শিখছে না। 

পরীক্ষা মানে পাশ আর ফেল। যারা পাশ করছে তারা নিঃসন্দেহে মেধাবী। কিন্তু যারা পাশ করছে না তারা কি মেধাশূণ্য? কোনো একটা বা দুইটা বিষয়ে ফেল করলেই কি তার মেধা নেই বলা যেতে পারে? শুধু ফলাফল দিয়ে নিশ্চয়ই কোনো ছাত্রছাত্রীর মেধা পরীক্ষা করা যায় না। কারণ স্কুল কলেজের পাশ ফেল শুধু সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেক উদাহরণ আছে যেখানে স্কুলে ছাত্র হিসেবে খুব খারাপ হয়ে পরবর্তী জীবনে বড় বড় ব্যাক্তিদের কাতারে নাম লিখিয়েছেন। এবং এই সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়। তাহলে পাশ ফেল এবং মেধা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হলেও  সম্পূর্ণ নির্ভর নয়।

আজকের যুগের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানানোর পেছনে যত শ্রম দেয় কেউ কবি সাহিত্যিক বা শিক্ষক বানানোর ক্ষেত্রে তার একাংশও দেন না। কারণ নিয়মিত লেখাপড়া করলে, ভালো ফলাফল করলে ডাক্তার হওয়া যায়। কিন্তু কবি হতে গেলে ওসব দরকার হয় না। তাহলে কি এমনিতেই হয়? আমার মনে হয় ওই কবি সাহিত্যিক হতে গেলেই মেধার দরকার বেশি হয়। মুখস্ত করে মনে রাখার চেয়ে দু’কলম তৈরির বীরত্বই বড়। তারপরও শিক্ষক বা এরকম পেশায় স্বেচ্ছায় আসতে চাওয়া ছাত্রছাত্রীর কথা খুব কমই আছে।

একটা ঘটনা বলি- আমাদের অভিভাবকদের বোঝা উচিত যে সন্তানের মেধা যে পথে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায় বা পূর্ণতা লাভ করে সে পথেই তার প্রকৃত মঙ্গল রয়েছে। বাকি পথ কেবল জোর জবরদস্তির। আবার বিজ্ঞান বিভাগে পড়ালেখা করলেও আবিষ্কারক হওয়ার কথা কিন্তু তেমন একটা কেউ বলে না। কারণ প্রথম প্রথম ওতে শুধুই ধৈর্য্য লাগে পয়সা আসে না। কিন্তু অবাক বিষয় হলো মাঝে মাঝে পত্রিকায় দেশের আনাচে কানাচে যেসব আশা প্রদানকারী নতুন কিছু আবিষ্কারের খবর চোখে পড়ে তার বেশিরভাগই তেমন উচ্চ শিক্ষিত নয়। বরং দীর্ঘদিন ওই বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে করতে একান্তই ইচ্ছা থেকে সে আবিষ্কারটি করে ফেলে। এখানে বিজ্ঞান তার কাছে নেশা বা ভালোবাসা। তাই বিষয়ভিত্তিক ভালোবাসা ভিন্ন বিষয়। কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ফেল করলেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। বরং অন্য কোনো বিষয়ে তার আগ্রহ আছে ধরে নিতে হবে। কোনো নির্দিষ্ট পরীক্ষায় ফেল বা কম মার্ক পেলেই জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। শেষ পর্যন্ত যদি কোনো ছাত্রছাত্রী পাস না করতে পারে তার জন্য প্রচলিত সংস্কৃতি অনুসারে তার ফেল করার কারণ উদঘাটন করতে ব্যাস্ত না হয়ে তাকে বোঝানো যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত তো সে অবশ্যই জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। জীবনযুদ্ধের পরীক্ষার মতো কঠিন পরীক্ষা আর কি আছে। পাস করাটাকে আমরা যত সহজে প্রচার করি ফেল করাটাকে গ্রহণ করার মন-মানসিকতা আজও গড়ে ওঠেনি। যার কারণে একেবারেই অর্থহীনভাবে কয়েকটি জীবন প্রত্যেক পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরই ঝরে যায়। এর দায় কে নেবে? 
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনাকে ধন্যবাদ ভেদরগঞ্জ কোচিং সেন্টার এন্ড ট্রেনিং ইন্সটিটিউট পরিবারের পক্ষ থেকে।